রাঙ্গামাটি l রাঙ্গামাটি দর্শনীয় স্থান, কিভাবে যাব?

রাঙ্গামাটি
রাঙ্গামাটি

আসসালামু আলাইকুম আশা করি সকলে ভালো আছেন। আজ আমরা আলোচনা করব রাঙ্গামাটি জেলার দর্শনীয় স্থান নিয়ে। আশা করি সঙ্গেই থাকবেন। স্বচ্ছ পানির বুকে ভাসমান পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে চলে যান রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটি জেলা চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হ্রদ, বন, ঝরনা এবং সবুজ পাহাড়ে ঘেরা দেশের এই বৃহত্তম জেলাটি প্রাণে ভরপুর এক বিস্ময়কর স্থান।

চলুন জেনে নিই রাঙামাটির কিছু দর্শনীয় স্থানের নাম-

কাপ্তাই লেক,রাঙ্গামাটি

কাপ্তাই হ্রদ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত একটি কৃত্রিম হ্রদ এবং রাঙ্গামাটির অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। এই হ্রদের আয়তন ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার। এটি একটি কৃত্রিম লেক হলেও এর সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। লেকের চারপাশে ছোট-বড় পাহাড়, ঘোরাঘুরির পাহাড়ি রাস্তা আর জলপ্রপাত কাপ্তাইয়ের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। আপনি সারা বছর কাপ্তাই লেক ঘুরে আসতে পারেন। তবে বর্ষাকালে লেকের কাছের ঝর্ণাগুলো নিখুঁত। তাই বর্ষাকাল কাপ্তাই হ্রদে ভেসে বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। মূলত কাপ্তাই লেককে ঘিরেই রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। তাই মোটর বোটে করে কাপ্তাইয়ের তীর ঘেঁষে বিভিন্ন পর্যটন স্থান ঘুরে আসতে পারেন।

নির্বাণ নগর বৌদ্ধ মন্দির, রাঙ্গামাটি

কাপ্তাই হ্রদের অজস্র জলের মাঝে বিলীন গৌতম বুদ্ধের মূর্তি যে কোন ভ্রমণপ্রেমীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এই বৌদ্ধ মন্দিরটি কাপ্তাই হ্রদের একটি দ্বীপে নির্মিত। মন্দিরের নাম আরও সুন্দর, ‘নির্বাণ নগর বন বিহার’। বৌদ্ধ মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা ২৯ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা একটি বুদ্ধমূর্তি স্থানটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। কাপ্তাই লেক থেকে শুভলং যাওয়ার পথে এই সুন্দর মন্দিরটি দেখা যায়।

শুভলং ঝরনা, রাঙ্গামাটি

‘লাল মেঘে বৃষ্টি ঝরে আদিবাসী কোনো গ্রামে

তোমার কান্না, আমার কান্না ঝিরিপথ হয়ে নামে।’

বলা হয়ে থাকে জলপ্রপাত পাহাড়ের কান্না। বর্ষা মৌসুমে তিনশ ফুট উচ্চতা থেকে শুভলং ঝরনার পানির স্রোত দেখলে মনে হয় পাহাড় যেন মুষলধারে কাঁদছে। শুভলং জলপ্রপাতের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য এবং সুরেলা সুর পর্যটকদের মোহিত করে। কিন্তু আপনি শুধু বর্ষাকালেই বৃষ্টির পূর্ণ রূপ দেখতে পাবেন।

রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলায় শুভলং পড়ে। কালিতং তুগ এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, যা প্রায় ১,৮৭০ ফুটে দাঁড়িয়ে আছে। এই চূড়া থেকে আপনি পুরো রাঙ্গামাটি শহর দেখতে পারেন। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় কাপ্তাইয়ের জলে ভাসছে স্বর্গের টুকরো। এছাড়াও, আপনি ভারতের মিজোরাম রাজ্যও দেখতে পারেন। স্থলপথে শুভলংয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কাপ্তাই লেক পেরিয়ে এখানে পৌঁছাতে হবে।

ধুপপানি ঝরনা, রাঙ্গামাটি

এই সাদা জলের ঝর্ণার গর্জন ২ কিমি দূর থেকে শোনা যায়। ধুপ্পানি ঝর্ণার বিশেষত্ব হল এখানে যেতে হলে আপনাকে খুব শান্ত হতে হবে। এই নির্জন ও নীরব ঝরনায় জোরে কথা বলাও নিষেধ। তবেই ধ্যানমগ্ন সাধক জাগ্রত হবে! এই ঝর্ণার পাদদেশে একজন সাধু সাধু আশ্রমে ধ্যান করছেন। স্থানীয় ভাষায় একে ‘ভান্তে’ বলে। মানুষের কোলাহল যাতে সাধুর ধ্যানে ব্যাঘাত না ঘটায়, সেজন্য এলাকাবাসী শব্দ নিষিদ্ধ করেছে।

রাঙ্গামাটি বিলাইছড়ি উপজেলার ওড়াছড়িতে এই ঝর্ণাটির অবস্থান। সমতল থেকে এই জলপ্রপাতের উচ্চতা প্রায় ১৫০ ফুট। কয়েক বছর আগেও লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল ঝর্ণাটি। এটি ধীরে ধীরে ২০০০ সালের দিকে প্রকাশ পায়, যখন একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বনের গভীরে একটি ধূপ ফোয়ারার নীচে ধ্যান করতে শুরু করেছিলেন।

ধুপ্পানি ঝর্ণায় যেতে হলে একটি কঠিন ও খাড়া পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হয়। ধুপ্পানি পাড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আপনি পাহাড়ের উপর শহরটি দেখতে পাবেন। আড়াই ঘণ্টা হাঁটার পর শুনতে পাবেন জলপ্রপাতের শব্দ। পৌঁছানোর পরে, ধুপ্পানি ঝর্ণার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ট্রেকটিকে মূল্যবান করে তুলবে।

ফুরোমন পাহাড়, রাঙ্গামাটি

রাঙ্গামাটি শহরের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ ফুরোমন পাহাড়। পাহাড়ের নাম থেকেই বোঝা যায়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এটি সমান সুন্দর। চাকমা ভাষায় ফুরোমন মানে উগ্র মন। ফুরোমন এর নাম পেয়েছে কারণ পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে মন উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

এর উচ্চতা ১,৫১৮ ফুট। আপনি যদি পাহাড়ের চূড়ায় যান, আপনি প্রাকৃতিক প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে সক্ষম হবেন। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তা খুবই বিপজ্জনক। পাহাড়ের ঢাল, খাড়া পাহাড় ও গিরিখাত পেরিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৬০০ ফুট উচ্চতায় উঠলে আপনি একটি ভিন্ন জগত দেখতে পাবেন। ফুরোমনের চূড়া থেকে কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ নীল জল, সবুজ পাহাড় আর বিস্তীর্ণ আকাশ দেখে মনে হয় চোখের সামনে স্বর্গপুরী নেমে এসেছে।

ঝুলন্ত সেতু, রাঙ্গামাটি

রাঙ্গামাটি শহরের শেষ প্রান্তে লেকের উপর একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মিত হয়েছে। সেতুটি ৩৩৫ ফুট লম্বা এবং ৮ ফুট চওড়া। ১৯৮৬ সালে নির্মিত এই সেতুটি এখন ‘রাঙামাটির প্রতীক’ হয়ে উঠেছে।

আপনি যখন সেতুতে থাকবেন, আপনি দেখতে পাবেন লেকের অবিরাম জল এবং উঁচু-নিচু পাহাড়ে ঘেরা বনাঞ্চল। দৃষ্টিনন্দন এই ঝুলন্ত সেতু যেকোনো দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম।

রাজবন বিহার, রাঙ্গামাটি

পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় তীর্থস্থান রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী রাজবন বিহার। বিহার বা মন্দিরকে চাকমা ভাষায় ‘কিয়াং’ বলা হয়। রাজবন বিহার বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ বিহার হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৩৩.৫ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত বিহার অঞ্চলে 4টি মন্দির, ভিক্ষু ভাবনা কেন্দ্র, বেইনগড়, তাবাটিংশ স্বর্গ, একটি বিশ্রামাগার এবং একটি হাসপাতাল রয়েছে।

পলওয়েল পার্ক, রাঙ্গামাটি

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আধুনিক স্থাপত্যের এক অপূর্ব সমন্বয় এই পার্কটি রাঙামাটির অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রাঙামাটি জেলা পুলিশ কাপ্তাই হ্রদের তীরে পাওলোটেল পার্কটি পরিচালনা করে।

পার্কের অন্যতম আকর্ষণ হল ‘লাভ পয়েন্ট’, যা একটি বিশেষ ‘লাভ’ সাইন হুইল যা লাভ লক নামে পরিচিত। ভালোবাসার বন্ধনকে চিরস্থায়ী করতে অনেকেই এখানে তালা দিয়ে আসেন। লোহা ও রড দিয়ে তৈরি বিশাল চাকাটির ভেতরে মানুষ প্রিয়জনকে বাহারি নকশার তালাসহ নিয়ে চাবিটি লেকে ফেলে দেয়।

জুমঘর রেস্টুরেন্ট, রাঙ্গামাটি

প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে পাহাড়ি খাবারের স্বাদ নিতে চলে যান জুমঘর রেস্টুরেন্টে। পর্যটকদের কাছে এখনো জনপ্রিয় না হলেও কাপ্তাইয়ের ধারে পাহাড়ের ওপর নির্মিত এই রেস্টুরেন্টটি বেশ জনপ্রিয়। খাবারের মানও বেশ ভালো। খাওয়ার পর পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘর নিয়ে তৈরি জাদুঘর ঘুরে আসতে পারেন প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা।

সুবলং ঝর্ণা, রাঙ্গামাটি

সুবলং ঝর্ণা রাঙ্গামাটি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে বরকল উপজেলায় অবস্থিত। দেশের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত হিসেবে পরিচিত সুবলং ঝর্ণা বর্ষা এলেই প্রাণ ফিরে পায়। প্রায় ৩০০ ফুট উচ্চতা থেকে পতিত জল পর্যটকদের জন্য একটি দুর্দান্ত আকর্ষণ। সমুদ্রপথে আসতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে।

মুন্সী আব্দুল রউফের সমাধি, রাঙ্গামাটি

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি প্রধান শহর থেকে সমুদ্রপথে ১৫ কিলোমিটার দূরে স্বচ্ছলরাশি অধ্যুষিত একটি ছোট দ্বীপ চিংরিখালে অবস্থিত। এর চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটকদের মোহিত করে।

আরণ্যক রিসোর্ট, রাঙ্গামাটি

সেনাবাহিনীর ব্যারাক হলেও এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। লেক আর পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য নিয়ে নির্মিত এই রিসোর্টটি পর্যটকদের জন্য আলাদা বিনোদন।

রাঙ্গামাটি যাতায়াত ব্যবস্থা

কল্যাণপুর, সায়েদাবাদ, ঢাকা থেকে সরাসরি রাঙ্গামাটির গাড়ি পাওয়া যাবে। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ছাড়া মানুষের জন্য বর্তমান ভাড়া ৭৫০ টাকা। আপনি সহজেই হানিফ, শ্যামলী, ইউনিক, ডলফিন সহ অন্য যেকোনো গাড়ি পেতে পারেন। চট্টগ্রামের অক্সিজেন জংশন ও বড় দীঘি থেকে পাহাড়ি গাড়িতেও রাঙ্গামাটি যাওয়া যায়। চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত গাড়ি ভাড়া ১৪০ টাকা।

রাঙ্গামাটিতে কোথায় থাকবেন

রাঙ্গামাটিতে থাকার জন্য ছোট-বড় বেশ কিছু হোটেল ও লজ রয়েছে। বনরূপা, দোয়েল চত্বর, তবলছড়ি এবং রিজার্ভ বাজারে এই হোটেলগুলো পাবেন। আপনি যাওয়ার আগে বা সরাসরি এই হোটেলগুলিতে যাওয়ার পরে আপনি বুক করতে পারেন। সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে ভ্রমণের আগে আপনার পছন্দের উপর ভিত্তি করে বুক করতে ভুলবেন না। কারণ অনেক পর্যটকের চাপে পছন্দের রুম না পেলে অবসর ভ্রমণে বিষাদের ছাপ পড়ে যেতে পারে।

রাঙ্গামাটি পণ্যের বিভিন্ন প্রকার

রাঙ্গামাটিতে আপনি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ পাবেন। জেলার তবলছড়ি টেক্সটাইল মার্কেটে, আপনি খুব সাশ্রয়ী মূল্যে হাতে বোনা শাড়ি, বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পণ্য, অলঙ্কার, বার্মিচ আচার এবং আপনার প্রিয় কিছু ভ্রমণ স্যুভেনির খুঁজে পেতে পারেন।

প্রকৃতির কোমল কোলে জীবন্ত হয়ে আসা অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকের ভিড়ে রাঙ্গামাটি। পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি এখনও দূষণমুক্ত এবং সৌন্দর্যের এক অপূর্ব স্বর্গ। পরিবেশ দূষণের এই ভয়াবহ সময়ে রাঙ্গামাটি একটি পরিবেশবান্ধব শহর। সমতল ও পাহাড়ের বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই অঞ্চলটি পাহাড়ী। আর বৈচিত্র্যময় এই জেলার কারণে বাংলাদেশের সৌন্দর্য বিশ্ব দরবারে উঠে দাঁড়াতে পারে। এভাবে দেশকে জানা, আরও ভ্রমণ এবং দেশের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করা।

পরিশেষে

আশা করি আপনারা আপনাদের কর্ম ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করতে রাঙ্গামাটি জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ ঘুরে আসবেন। পুরো আর্টিকেল সাথে থেকে পড়ার জন্য আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *