আসসালামু আলাইকুম আশা করি সকলে ভালো আছেন। আজ আমরা আলোচনা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নিয়ে। আশা করি সঙ্গেই থাকবেন। ব্রিটিশ শাসনামল কালে কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়াও ছিলেন ভারতের সম্রাজ্ঞী। তার রাজত্ব ১৮৫৭ থেকে ২২ জানুয়ারী, ১৯০১ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেই বিশেষ দিনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এবং তার মৃত্যুর পর, ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয় উপনিবেশে তার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল তাজমহলের আদলে তৈরি করা হবে স্মৃতিস্তম্ভ।
যদিও এতে ইউরোপীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া থাকবে সেখানে। রানির সম্মানে স্মৃতিস্তম্ভটির নামকরণ করা হয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। আগাগোড়ার শ্বেতপাথরের স্মৃতিস্তম্ভ এখন একটি জাতীয় যাদুঘর এবং কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ স্থান। কলকাতা শহরের ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটিকে ঘিরে রয়েছে নানা চমকপ্রদ সব ঘটনা। সেসব ঘটনা হয়তো অনেকেই জানেন না।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নকশা
স্যার উইলিয়াম এমারসন বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্য শৈলীতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ডিজাইন করেছিলেন। যদিও তাকে প্রাথমিকভাবে ইতালীয় রেনেসাঁ শৈলীতে স্মৃতিস্তম্ভের নকশা করতে বলা হয়েছিল, তবে তিনি একা ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রয়োগকে প্রতিরোধ করেন এবং ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীতে মুঘল উপাদান যুক্ত করে মূল স্মৃতিস্তম্ভের নকশা করেছিলেন। ভিনসেন্ট এসচ ছিলেন এই স্মৃতিস্তম্ভের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি। স্মৃতিস্তম্ভ সংলগ্ন বাগানটি লর্ড রেডসডেল এবং স্যার জন প্রেইন দ্বারা ডিজাইন করা হয়ে থাকে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অবকাঠামো
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উত্তরে কুইন্স ওয়ে, ডান্সিং ফাউন্টেন এবং তারপর বিশাল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, দক্ষিণ দিকে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড এবং তারপর আইপিজিএমইআর এবং এসএসকেএম হাসপাতাল, পূর্বে কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল, এম.পি.এ.জি. বিড়লা তারামন্ডল এবং রবীন্দ্রসদন, আর পশ্চিমে কলকাতা ময়দান রেসকোর্স অবস্থিত। স্মৃতিসৌধ ভবনের উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিকেই রয়েছে বিশাল বিশাল দরজা। উত্তর গেট থেকে ভবন পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে দুটি বড় গুদাম পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখেন এবং একই সঙ্গে প্রদর্শনীর সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেন। সব বয়সী প্রেমিক প্রেমিকারা দৃশ্যটি দেখে বা ধারণ করে নস্টালজিক বোধ করেন থাকেন। সুন্দর বাগানের চারপাশে গাছের গুঁড়িতে অনেক তরুণ প্রেমিক বসে থাকেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বৃহৎ সাদা পাথরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। স্মৃতিস্তম্ভটি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে উদ্বোধন করেন। সমাধির সর্বোচ্চ গম্বুজে বিজয়দূতির একটি কালো ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে যা একটি বিউগল বাহিত। মূর্তি, একটি বল বহনকারী পেডেস্টালের উপর স্থাপিত, যখন বাতাসের প্রবাহ শক্তিশালী হয় তখন আবহাওয়ার ভেন হিসাবে কাজ করে থাকেন।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার নামানুসারে করা হয়
রানী ভিক্টোরিয়া ২২ জানুয়ারী, ১৯০১ তারিখে মারা যান। তার রাজত্বও একটি অকথ্য মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়েছিল। রানীর মৃত্যুর পর তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন কলকাতায় একটি তড়িঘড়ি বৈঠক ডাকেন। প্রয়াত রানীকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানানোর প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। তাক দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। যেখানে থাকবে অনেক গাছ আর ফুলের বাগান। ভাইসরয় চেয়েছিলেন পর্যটকরা সৌধটি দেখতে কলকাতায় ভিড় জমাবেন। তার উদ্দেশ্য ছিল তাজমহলে ঝড় তোলা। তবে তাজমহলকে হারাতে না পারলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে তাজের গলায় কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঠিকই।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রাজা পঞ্চম জর্জ
কুইনস মেমোরিয়াল বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ১৯০১ সালে প্রস্তাবিত হয়। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এর নকশা তৈরি সহ অন্যান্য কাজ এগিয়েছিল। ১৯০৬ সালে স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ শুরু হয়ে থাকে। রাজা পঞ্চম জর্জ দ্বারা স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তিনি তার বোন ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর রাজা হবেন। কিন্তু তার পিতা এডওয়ার্ড সপ্তম বেঁচে থাকা পর্যন্ত তিনি রাজা হতে পারেননি। পঞ্চম জর্জ যখন ভারতে আসেন, তখন তিনি ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের জাতিগত বিদ্বেষ দেখে গভীরভাবে বিরক্ত হয়ে থাকেন। তিনি ভারতীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে ভারতীয়দের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করেন। তাঁর রাজত্বকালেই ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়।
প্রেসিডেন্ট জেলের জমি
যে জমিতে আজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দাঁড়িয়ে আছে সেটি হলো প্রেসিডেন্ট জেলের জমি। এই কারাগারে মূলত সকল রাজনৈতিক বন্দীদের রাখা হতো। তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণের প্রস্তাবের পর সেই জমি থেকে প্রেসিডেন্সি জেল আলিপুরে স্থানান্তর করা হয়। জেলখানা এখনো রয়েছে।
তাজমহলের অনুসরণে শ্বেতপাথরের মাকরানা বিজয়
হঠাৎ দেখা হলে ভিক্টোরিয়া তাজমহল ভেবে ভুল করে অনেকে। আসলে, এই স্মৃতিস্তম্ভটি তাজমহলের পরে নির্মিত হয়েছিল। স্যার উইলিয়াম এমারসন বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্য শৈলীতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ডিজাইন করেছেন। তাকে ইতালীয় রেনেসাঁর স্থাপত্য শৈলীতে স্মৃতিস্তম্ভের নকশা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি শুধুমাত্র ইউরোপীয় স্থাপত্যের প্রয়োগে আগ্রহী ছিলেন না।
তাই এমারসন ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীর সাথে মুঘল শিল্পের সমন্বয়ে মূল ভবনের নকশা করেন থাকেন। মিশরীয়, ইসলামিক, ভেনিসীয় এবং দাক্ষিণাত্য সংস্কৃতির প্রভাবও ভিক্টোরিয়াতে স্পষ্ট। তাজমহলের পরে ছিল শ্বেতপাথরের মাকরানা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। পাথরটি রাজস্থান থেকে আনা হয়েছিল। বিশাল স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৫৬ মিটার। এর মাঝখানে একটি বড় গম্বুজ এবং চার পাশে চারটি ছোট গম্বুজ এর অবস্থান।
দেশের টাকায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ
ব্রিটিশ ভাইসরয় রানির একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এর তৈরির খরচ মূলত দেশের মানুষই বহন করে থাকেন। সেই তুলনায় ব্রিটিশদের খরচ অনেক কম হয়। লর্ড কার্জন ভারতীয় রাজা, জমির মালিক, ধনী অভিজাত এবং ব্যবসায়ীদের কাছে এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের জন্য অর্থ দান করার জন্য আবেদন করেছিলেন। বাস্তবে এটা ছিল ভাইসরয়ের আদেশ আর কি। সেই আদেশের বিরোধিতা করার সাহস কারো ছিল না কারো। সে সময় স্মৃতিসৌধটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ টাকা।
এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কালো আঁকা হয়েছিল
শ্বেতপাথরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটি একবার সম্পূর্ণভাবে আঁকা হয়েছিল। সালটা ছিল ১৯৩১ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। এমনকি জাপানী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ব্রিটিশ সরকার ভিক্টোরিয়ার ছবি প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয় হয়। শ্বেতপাথরের ভবনটি দূর থেকে দেখা যায়। ফলে সেসব জায়গায় বোমা ফেলা সহজ ছিল। তাই সতর্কতা হিসেবে ভিক্টোরিয়াকে কালো রঙ করা হয়ে থাকে।
পরিশেষে
আশা করি আপনারা আপনাদের কর্ম ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করতে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর ঐতিহ্য দেখার জন্য ঘুরে আসবেন। সেখানে পর্যটকদের অনেক ভীড় দেখা যায়। সেখানে গেলে আপনারা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর আরো বিস্তারিত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন। পুরো আর্টিকেল সাথে থেকে পড়ার জন্য আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।