আসসালামু আলাইকুম আজ আমরা সিলেট এর জাফলং সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করব, যে তথ্য পেলে আশা করি আপনাদের উপকার এ আসবে। বিচিত্রতার কষ্টিপাথরে বাংলাদেশকে যাচাই করতে হলে ঘুরে আসতে হবে আপনাদের দেশের উত্তর-পূর্বের সিলেট বিভাগে। প্রাকৃতিক সম্পদ, শিল্প ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এর সমৃদ্ধ জেলাগুলো দেশের সেরা বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে থাকে সিলেট বিভাগ। শুধুমাত্র এক জাফলং ভ্রমণ যেকোনো পরিব্রাজকের মনে এক টুকরো বাংলাদেশকে গেঁথে দিতেই যথেষ্ট। চলুন, পাহাড়, নদী ও বনের এই অনিন্দ্য সমারোহকে খুব কাছ থেকে দেখার উপায়টি জেনে নেওয়া যাক।
জাফলং নামকরণের ইতিহাস
“জাফলং” নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খাসি জনগোষ্ঠীর হাজারও বছরের পুরনো ইতিহাস। সংক্ষেপে বলতে গেলে খাসিদের মালনিয়াং রাজ্য থাকা কালে এর রাজধানীগুলোর একটি ছিল বল্লাপুঞ্জি অঞ্চল। এই বল্লাপুঞ্জি মূলত জাফলং এর একটি অঞ্চল। প্রাচীন এই মালনিয়াং রাজ্যেই উৎপত্তি হয়েছিল “জাফলং” নামটির, যার মাধ্যমে আনন্দের হাট বোঝানো হতো আর কি।
জাফলং এর ভৌগলিক অবস্থান
দর্শনীয় এই জাফলং এর অবস্থান সিলেট বিভাগীয় শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। পাহাড়টি মেঘালয় সীমান্তে আলাদা করেছে বাংলাদেশ ও ভারতকে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলটি পড়েছে সিলেট বিভাগের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর ধারায়। ভারতের ডাউকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাওকি নদী জাফলং হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে।
জাফলং ভ্রমণের সেরা সময় কোনটি
জাফলং এমন এক জায়গা যা প্রতি ঋতুতেই নতুন রূপে সেজে ওঠে থাকে। তবে বৃষ্টির মৌসুমে এই প্রকৃতি কন্যা নিজের সকল সৌন্দর্য যেন উজাড় করে দেয়। স্বচ্ছ স্রোতধারায় নিচে পাথরের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা, আর সংগ্রামপুঞ্জীর মায়া দৃষ্টি ভরে নিতে চাইলে আসতে হবে অবশ্যই আপনাকে বর্ষাকালে। তাছাড়া জুন থেকে অক্টোবরের সময়টাতে, এমনকি নভেম্বরেও পাহাড়ের সবুজটা যেন আরও বেশি করে ফুটে ওঠে থাকে।
জাফলং এ গিয়ে যা দেখতে পাবেন
পিয়াইন নদীর হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের চূড়া খোঁজার অনুভূতির সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা করা চলে না। অদূরে জলপ্রপাত ঝুলন্ত সেতুর নিচ দিয়ে এসে যখন দু’পা স্পর্শ করে তখন সারা শরীরে বয়ে যাবে হিম-শীতল শিহরণ অন্য এক অনুভূতি। কেননা ব্রিটিশ শাসনামলে গড়ে উঠা এই সেতু সাক্ষী হয়ে আছে ১৮৯৭-এর ভূমিকম্পে সৃষ্টি হওয়ার ডাউকি ফল্টের।
এছাড়া পিয়াইনের শাখা ডাওকি নদীর সর্পিলাকার প্রবাহটাও অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে কাছে টানে পর্যটকদের। নৌকা করে ডাউকি নদীপথে কিছুক্ষণ ভেসে গেলেই দূরে থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে সংগ্রামপুঞ্জি বা মায়াবী ঝর্ণাটি। আর পিয়াইন নদী পেরোলেই ওপারে খাসিয়াদের গ্রাম পড়বে। পাহাড়ের কোলে তাদের অদ্ভুত বাড়ি নির্মাণশৈলী আর পানের বরজ হাজার হাজার পর্যটকের বিস্ময়ের খোরাক যুগিয়ে থাকে। অতঃপর সাক্ষাত মন্দিরজুম অবলীলায় গল্প বলতে শুরু করে খাসিদের ঐতিহ্যবাহী মালনিয়াং রাজ্যের কথা বলতে হয়।
পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে সারা দেশের মতো জাফলং ও আয়োজন করে থাকে বৈশাখী মেলার। উপলক্ষটা এক হলেও পাহাড়ে ঘেরা মুখরিত খরস্রোতা নদীর তীরকে অবশ্যই রাজধানীর জনস্রোতের মতো লাগবে না! কিন্তু সোনাটিলা গ্রামে প্রতিদিন বৃষ্টি হওয়ার কিংবদন্তি চাক্ষুষ দেখতে এখনও কৌতূহলী চোখে ঘুরে বেড়ান ভ্রমণপিপাসুরা।
জাফলং কিসের জন্য বিখ্যাত
খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়ের মাঝখানে ভারতের মেঘালয়ের সীমান্তে গাঁ ঘেসে অবস্থিত। এখানে পাহাড় এবং নদীর সংমিশ্রণ এই স্থানটিকে ভ্রমণকারীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ করে তোলে। এই জাফলং আবারও পর্যটকদের কাছে তার পাথরের জন্য বিখ্যাত।
ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার উপায় কি
ঢাকার গাবতলী, ফকিরাপুল, মহাখালী অথবা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের যেকোনোটি বাসে করে সিলেট যেতে পারবেন আপনারা। এগুলোতে এসি, নন-এসি এবং কোম্পানিভেদে জনপ্রতি ভাড়া পড়ে প্রায় ৭০০ থেকে ১,৫০০ টাকা হয়ে থাকে। পুরো যাত্রায় সময় লাগবে প্রায় সাত থেকে আট ঘণ্টা।
ট্রেন ভ্রমণ করতে চাইলে বিমানবন্দর কিংবা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে উঠে পড়লেই পৌঁছে যাবেন সিলেটের জেলায়। শ্রেণী ভেদে এগুলোর টিকেট মূল্য নিতে পারে মাথাপিছু সর্বনিম্ন প্রায় ৩২০ থেকে সর্বোচ্চ ১,০৯৯ টাকা পর্যন্ত। এই যাত্রাতেও কমবেশি সাত থেকে আট ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। সবচেয়ে দ্রুত সময়ে সিলেট পৌঁছানোর একমাত্র উপায় বিমানে যেতে হবে আপনারা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এই যাত্রায় বিভিন্ন শ্রেণী অনুযায়ী খরচ পড়তে পারে প্রায় ৩,৫০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকার মধ্যে। মাত্র ৩০ থেকে ৫০ মিনিটে এই যাত্রা শেষ হয়ে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে।
সিলেট থেকে জাফলং উপায়
সিলেটের কদমতলী এবং সোবহানীঘাট থেকে জাফলং এর সব গুলো বাস ছেড়ে যায়। এগুলোতে ভাড়া নেয় জনপ্রতি প্রায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা করে। জাফলং যাওয়ার জন্য সিএনজি ও লেগুনা সার্ভিসও রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে মাইক্রোবাসও ভিড় করে থাকে বন্দরবাজারের শিশুপার্ক গুলোর আসে পশে।
এছাড়াও সিলেটের প্রায় সব জায়গাতেই রিজার্ভ করে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাওয়া যায়। তবে যে যানবাহনেই যাওয়া হোক না কেন, সরাসরি জাফলং পৌঁছতে প্রায় দেড় থেকে ২ ঘণ্টা সময় লেগে যাবেই আপনাদের। যাওয়া আসাসহ সারাদিনের জন্যে সিএনজি ভাড়া নিতে পারে প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ টাকার মধ্যে। খরচটা লেগুনার ক্ষেত্রে হয়ে যাবে প্রায় ২,০০০ থেকে ২,৫০০ টাকা মতো। মাইক্রোবাস রিজার্ভ করার জন্য প্রায় ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা লাগতে পারে।
এই গাড়িগুলো বিভিন্ন পথে জাফলং এর জিরো পয়েন্টে নিয়ে যাবে। তবে রিজার্ভ গাড়িতে পছন্দমত রাস্তা ব্যবহার করার সুবিধা থাকে। বিশেষ করে গুচ্ছগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প দিয়ে যাওয়ার রাস্তাটি উত্তম। অবশ্য এখন জাফলং যাওয়ার রাস্তাগুলো আগের থেকে অনেক উন্নত করা হয়েছে।
জাফলং এ থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা কেমন
জাফলং এ থাকার জন্য মামার বাজারে অল্প কিছু রেস্ট হাউজ বিদ্ধমান। সরকারি রেস্ট হাউজটিতে থাকার জন্য অনুমতি নিলে আপনারা থাকতে পারবেন। আরও ভালো হোটেলে থাকতে হলে ফিরে যেতে হবে সিলেট জেলা শহরে। শহরের অধিকাংশ হোটেলগুলো শাহজালাল মাজারের আশেপাশেই রয়েছে। দরগা গেট থেকে আম্বরখানা, জিন্দাবাজার, লামাবাজার, তালতলা, কদমতলী পর্যন্ত বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যাবে। তার মধ্যে দরগা গেট এলাকায় রুম ভাড়া পাওয়া যাবে প্রায় এক থেকে দুই হাজার টাকায়।
অভিজাত হোটেলগুলোতে প্রায় ২,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত লেগে যায়। রিসোর্টগুলোর কোনো কোনোটিতে প্রায় ৮,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত খরচ লাগতে পারে। জাফলং এ মোটামুটি মানের কিছু রেস্টুরেন্ট আছে যেগুলোতে যেকোনো বেলা পেট ভরে খাওয়া সম্ভব। সিলেট শহরে সাশ্রয়ী মূল্যে খেতে হলে যেতে হবে আপনাদের জিন্দাবাজারের রেস্টুরেন্টগুলোতে। এগুলোর বিশেষত্ব বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, খিচুড়ি এবং মাংসের অভিনব পরিবেশন। এগুলোতে সকালের নাস্তায় খরচ পড়তে পারে জনপ্রতি প্রায় ৫০ থেকে ১০০ টাকায়। আর দুপুর বা রাতের খাবারের জন্য জনপ্রতি প্রায় ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
জাফলং এর কাছাকাছি দর্শনীয় স্থান সমূহ
- লালাখাল
- তামাবিল
- জৈন্তাপুর
- সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা / মায়াবী ঝর্ণা
- সংগ্রামপুঞ্জি চা বাগান
- ডিবির হাওর শাপলা বিল
কিছু জাফলং ভ্রমণ টিপস
- গ্রুপ করে গেলে ভাল, খরচ কম হবে।
- কিছু কিনতে বা খেতে চাইলে দরদাম করে নিন।
- যেহেতু জাফলং সীমান্তবর্তী এলাকা, তাই সীমান্ত এলাকার নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
- গাড়ি ঠিক করার সময় দরদাম করে নিবেন।
- পানিতে নামার সময় সতর্ক থাকুন, পাথর উত্তোলনের ফলে অনেক যায়গা বেশ গভীর রয়েছে।
- স্থানীয়দের সাথে সুন্দর ব্যবহার করুন।
- এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন যা প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর হবে।
পরিশেষে
স্বচ্ছ পানির নদী, চিত্তাকর্ষক ঝুলন্ত ব্রিজ এবং পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসতি, এর সবেই মিলবে সিলেটের আপনার জাফলং ভ্রমণের পথে। এক নিমিষে এত কিছুর সাক্ষাত দেশের অন্য কোথাও পারেন বলে আমার মনে হয় না। সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে প্রকৃতি কন্যার আতিথেয়তার কোনো কমতি নেই।এরপরেও সে পরম বিনয় ভরে পর্যটকদের নির্দেশ করে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার দিকে। আর এই অপরূপ লাবণ্যতার জন্যই আবারও ফিরে যেতে মন চাইবে আপনার পিয়াইন নদীর বুকে। তাই, আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ রইল সিলেট জেলার এই অপরূপ সৌন্দর্যের জাফলং ঘুরে আশার। সাথে থেকে পুরো আর্টিকেল পড়ার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ।