জাতীয় স্মৃতিসৌধ l জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি কে?

জাতীয় স্মৃতিসৌধ
জাতীয় স্মৃতিসৌধ

জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও নিহত বেসামরিক বাঙালি ও অবাঙ্গালিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। জাতীয় স্মৃতিসৌধ সাভারে অবস্থিত।  জাতীয় স্মৃতিসৌধ এর নকশা প্রণয়ন করেছেন স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের দশটি গণকবর রয়েছে। বিদেশী রাষ্ট্রনায়কগণ সরকারীভাবে বাংলাদেশ সফরে আগমন করলে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রাচারের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা আরিচা মহাসড়কের পাশে নবীনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এর শিলান্যাস করেন। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতীয় স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের উদ্যাগ গ্রহণ করেন এবং নক্‌শা আহবান করা হয়। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে প্রাপ্ত ৫৭টি নকশার মধ্যে সৈয়দ মাইনুল হোসেন প্রণীত নকশাটি গৃহীত হয়। ১৯৭৯ সালে মূল স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮২ সালে বিজয় দিবসের অল্প পূর্বে সমাপ্ত হয়। ২০০২ সালে গৃহীত প্রকল্প অনুযায়ী এখানে একটি অগ্নিশিখা, সুবিস্তৃত ম্যুরাল এবং একটি গ্রন্থাগার স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশ সফরকারী বিদেশী রাষ্ট্র প্রধানগণের নিজ হাতে এখানে স্মারক বৃক্ষরোপণ করে থাকেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ এর মিনার ব্যতিত প্রকল্পটির মহা পরিকল্পনা ও নৈসর্গিক পরিকল্পনাসহ অন্য সকল নির্মাণ কাজের স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থাপত্য অধিদপ্তর। নির্মাণ কাজের গোড়া পত্তন হয় ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে এবং শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ধীন গণপূর্ত অধিদপ্তর সমগ্র নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। বর্তমানে সৌধটির নির্মাণ কাজ তিন পর্যায়ে মোট ১৩.০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হয়।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ এর ইতিহাস

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।  যার ফলে নকশা আহ্বান করা হয়। তখন ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন স্মৃতিসৌধের নকশা জমা দেন। প্রায় ১৭-১৮ জন প্রতিযোগীর মধ্যে তিনি প্রথম হন এবং তার করা নকশা অনুসারে ঢাকার অদূরে সাভারে নির্মিত হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের সর্বমোট আয়তন ৮৪ একর। স্মৃতিস্তম্ভ পরিবেষ্টন করে রয়েছে ২৪ একর এলাকাব্যাপী বৃক্ষরাজিশোভিত। স্মৃতিসৌধটির উচ্চতা ১৫০ ফুট। সৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজাকৃতির দেয়াল নিয়ে গঠিত। দেয়ালগুলো ছোট থেকে বড়ক্রমে সাজানো হয়েছে। এই সাত জোড়া দেয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক পর্যায়কে নির্দেশ করে। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসাবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত হয়েছে।

সাভারে নির্মিত এই সৌধটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্মৃতিসৌধ, যেটি আমাদের অস্তিত্ব আর জাতীয়তাবোধের প্রতীক। আমাদের ইতিহাসের স্মার হয়ে আছে । আর এজন্যই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই স্মৃতিসৌধ দেখতে যান এবং শহীদদের প্রতি নিবেদন করেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। বিশেষ করে, জাতীয় দিবসগুলোতে পুষ্পবেদী আর মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এটি। যদি এখনো না যাওয়া হয়ে থাকে, তবে শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে আর এর অসাধারণ নির্মাণশৈলী অবলোকন করতে, বিজয়ের এই মাসেই ঘুরে আসুন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ থেকে।

স্মৃতিসৌধের ৭টি স্তম্ভ

দূর থেকে একটি ত্রিভুজ এর মত মনে হলেও, কাছ থেকে ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায় স্মৃতিসৌধটি সাত জোড়া ত্রিভুজ নিয়ে গঠিত। আসলে, প্রতিটি স্তম্ভ ত্রিকোণ আকৃতির এবং আলাদা আলদা উচ্চতা বিশিষ্ট হওয়ায়, একেক দৃষ্টিকোণ থেকে ৪৫ মিটার উচ্চতার এ সৌধটি দেখতে একেক রকম লাগে। প্রতিটি স্তম্ভ কংক্রিটের ঢালাই করা যা বাকি চত্বরের লাল ইটের নকশার মাঝে সৌধটিকে আলাদা করেছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধ এর এই সাত জোড়া দেয়াল মূলত আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ভিন্ন পর্যায়কে নির্দেশ করে। সাতটি ত্রিভুজে আবৃত দেয়াল নিয়ে গঠিত । এই সাতটি দেয়াল আমাদের জাতির জীবনে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নির্দেশ করে।

  • ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,
  • ৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন,
  • ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন,
  • ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন,
  • ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন,
  • ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং
  • ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করেই জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।

শেষ কথা

মূল ফটক থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত পৌঁছাতে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়। এই পথে রয়েছে উঁচু-নিচু তত্ত্বর যা স্বাধীনতা অর্জনের নানান চড়ায়ুত্রায় পার হওয়ার দিক নির্দেশ করে। এই পথের দুপাশে রয়েছে গণকবর এবং মাঝখানে একটি কৃত্রিম জলাশয়। গণকবর স্মরণ করিয়ে দেয় শহীদদের আত্মদান আর জলাশয় অশ্রুর প্রতীক। পুরো পথ লাল ইটের তৈরি যা রক্তের প্রতীক। ধন্যবাদ।

Bangladesh

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *