আসসালামু আলাইকুম আজ আমরা আলোচনা করব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে। চলুন আজকে ঘুরে আসা যাক দেশের সুনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় যাকে বলা হয় দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একবার চোখ বন্ধ করে কল্পনা করো তো, ভোরের শিশির বুকের উপর নিয়ে এক কচি দূর্বা ঘাস মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পড়েছে সূর্যের আলো, মাঠ ভর্তি এমন সব দূর্বাদল থেকে ঠিকরে এসে আলোর ঝিকিমিকি লাগছে তোমার চোখে। কিংবা কল্পনা করো বৃষ্টির কোনো একটা দিন, আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি, সে বৃষ্টির পানি আটকে যাচ্ছে ঝাঁকড়া এক গাছের পাতায়, অন্ধকার দিন আরো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে অমন গাছের গহীন ছায়ায়। কিংবা কল্পনা করো তো, তোমাকে বরণ করে নেবে বলে খোলা আর উন্মুক্ত মঞ্চে গীত-নৃত্য-বাদ্যে মঞ্চস্থ হচ্ছে শেক্সপিয়ার, মলিয়ের, বেকেট এর মতো বিশ্ববরেণ্য নাট্যকারদের নাটক। অথবা কল্পনা করো, তোমার খুব কাছেই জলের মধ্যে এক ঝা বক এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, আশেপাশে খুব নির্জন, কেবল মাঝে মাঝে নাম না জানা পাখির হুটহাট ডেকে ওঠা সেই নির্জনতার স্থির জলে শব্দের ঢেউ তুলছে। খুব রঙিন আর আকাঙ্খিত কল্পনা, তাই না? তুমি কি জানো, এই সকল কিছু তোমার জন্য এক সাথে বাস্তবে পাওয়া সম্ভব, যদি তুমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-এ পড়তে আসো? হ্যা, একজন জাবিয়ান হয়ে আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, এসো! ঠকবে না! জীবন আর প্রকৃতি এখানে তার ডালা খুলে বসে আছে তোমারি অপেক্ষায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি
এটি যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান আমলে, ১৯৭০ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ নিরসনের লক্ষ্যে, ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭০’-এর আওতায় ৬৯৮.৫৬ একর জায়গা জুড়ে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয় ঢাকা থেকে মাত্র ৩৪ কিলোমিটার দূরে, সাভারে, প্রকৃতির কোল ঘেঁষে থাকা এক স্থান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সুরত আলী খান। পরবর্তীকালে, ১৯৭০ সালের ২০শে আগস্ট এই বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। এর চার দিন পর, ২৪শে আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমেদ নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ক্লাস অনুষ্ঠিত হলেও, আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন হয় ১২-ই জানুয়ারি। বর্তমানে ১২-ই জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, ১৯৭৩ সালে ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, ১৯৭৩’ পাশ হলে মুসলিম শব্দটি লোপ পায়, এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাম নিয়ে পরিচালিত হতে থাকে। যেটি দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নামেও পরিচিত।
প্রতিষ্ঠালগ্নে অর্থনীতি, ভূগোল, পরিসংখ্যান, গণিত- এই চারটি বিভাগে মোট ১৫০ জন শিক্ষার্থী এবং ২১ জন শিক্ষক নিয়ে স্নাতক শ্রেণির কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি অনুষদের আওতাভুক্ত ৩৫টি বিভাগ এবং ৪টি ইন্সটিটিউট রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন
রাজধানী থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এটি ৬৯৭.৫৬ একর (২.৮ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
কেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-এ পড়া উচিত?
নয়ানাভিরাম ক্যাম্পাস
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিত সবুজ স্বর্গ নামে। এই ক্যাম্পাসে পা রাখলেই বুঝতে পারবেন নামের যথার্থতা কতটুকু। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পেরোলেই সু বিশাল খেলার মাঠ। চারদিকে নানা রকমের সবুজ, এর ফাঁকে ফাঁকে আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের সব বিল্ডিং। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় লেকের জলে সে বিল্ডিং-এর প্রতিচ্ছবি, জলের মধ্যে অল্প ঢেউয়ের কারণে সে প্রতিচ্ছবি নিয়ত কম্পমান। কিংবা ধরা যাক লন্ডন ব্রিজের লেকে, শীতের বিকেলে অতিথি পাখিদের ওড়াউড়ির ল্যান্ডস্কেপ। অথবা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের পাশের শান্তিনিকেতনের নিশ্চুপ পরিবেশ, মাঝে মাঝে ঘন হয়ে থাকা গাছের পাতার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সরসর বাতাসের শব্দ- এই সকল কিছু দেখতে হলে জাহাঙ্গীরনগরেই তো আসতে হবে
উৎসব মুখর এক সাংস্কৃতিক রাজধানী
এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় সাংস্কৃতিক রাজধানী যেখানে সামাজিক কর্মকান্ড গুলোকে খুব সুন্দরভাবে পালন করা হয় এবং তুলে ধরা হয়।সবুজ স্বর্গের মতো সাংস্কৃতিক রাজধানী উপাধিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিজের করে রেখেছে। বাংলায় বারো মাসে হয় তেরো পার্বণ, আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় চব্বিশ পার্বণ! প্রতিমাসেই কোনো না কোনো উৎসব ক্যাম্পাসে চলছেই, হয় অমুক ব্যাচের র্যাগডে, নয় তমুক ব্যাচের পুনর্মিলনী, কিংবা কোনো বিভাগের বর্ষপূর্তি, কিংবা কোনো একাডেমিক কনফারেন্স। আর উৎসবে তো মুক্তমঞ্চের নাটক, কনসার্ট, খেলাধুলা, মেলা, অডিটেরিয়ামে দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থাকবেই। তবে, ক্যাম্পাসের সবচেয়ে আনন্দ মুখর দিনগুলোর মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস আর হিম উৎসব। সপ্তাহব্যাপী হিম উৎসবে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অব্দি নাচ, গান, নাটক তোমাকে জীবনের রঙ চেনাবে।
আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশে এটি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেটিকে বলা হয় দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে শতভাগ ছাত্রছাত্রী আবাসিক হলে থেকে পড়াশোনা করার সুযোগ পায়। জাহাঙ্গীরনগর শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সর্বজন পরিচিত। অর্থাৎ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিজন ছাত্রের জন্য হলে একটি করে সিট বরাদ্দ রয়েছে। হলে থাকার বিষয়টা কেমন সেটা না থাকলে বলে বোঝানো সম্ভব না। ‘মানুষ’ নামের সত্ত্বাটাকে চেনার জন্য হল লাইফের গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ এখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্ররা আসে। ফলে একেকজনের একেক রকমের চিন্তা-ভাবনা, একেক অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ থাকে। হলে বেশ কিছুদিন থাকার কারণে সকলের মধ্যেই একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়, যার ফলে পুরো হল একটা পরিবার বলে মনে হয়। এতে করে যেকোনো বিপদে-আপদে বেশ কিছু মানুষকে পাশে পাবে তুমি। তাছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এত এত মানুষের সাথে থাকার ফলে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি হয়, যা কেবল ছাত্র জীবনে না, পরবর্তী জীবনেও কাজে লাগে। এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হলের ফিস্টের কথা তো না বললেই নয়! প্রতিবছর বছরের কিছু নির্দিষ্ট দিনে (যেমন ধরো স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসে) ক্যাম্পাসের হলগুলোতে ফিস্টের আয়োজন হয়। নামমাত্র মূল্যে কুপন কেটে ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ হলের ফিস্টে অংশ নেয়। মেয়েদের হলের ব্যপারটা আরো সুন্দর- ফিস্টের দিন শাড়ি পড়া, ছবি তোলা- এই বিষয়গুলো ফিস্টের আনন্দের মাত্রটা আরো বাড়িয়ে তোলে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার প্লেগ্রাউন্ড
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠটি রয়েছে হাতের বা দিকে। বিশাল আয়তনের এই খেলার মাঠের চারপাশ জুড়ে রয়েছে সবুজ গাছ-পালা। এটি শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠ হলেও এখানে ক্যাম্পাসের নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
শহীদ মিনার
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার টি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। ৫২ ফুট ব্যাস ও ৭১ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট শহীদ মিনারটি ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের ও ১৯৭১সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। শহীদ মিনার এর স্থপতি হলেন, রবিউল হুসাইন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ – Goarif ৮টি সিঁড়ি ও ৩টি স্তম্ভ বিশিষ্ট শহীদ মিনারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের সম্মুখে গোল চত্বরের মাঝে অবস্থিত।
৮ সিঁড়ি ও ৩ টি স্তম্ভ রহস্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ৮ সিঁড়ির রহস্য হচ্ছে, এই ৮টি সিঁড়ি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৮টি তাৎপর্যপূর্ণ বছর। বছর গুলো হল, ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ ।আর, তিনটি স্তম্ভের একটি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অপর ২টি মাটি ও মানুষ এবং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে।আশাকরি বুজতে পেরেছেন।
গোলাকার চত্বরের এই স্থানটি শিক্ষার্থীদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত। এখানে আড্ডা দেয়ার ধরাবাঁধা কোন নিয়ম নেই।
অতিথি পাখি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনেক জলাশয় রয়েছে। প্রতিবছর শীতের সময় এখানে প্রচুর অতিথি পাখি আসে।আমার পিছনে যে জলাশয়টি দেখছেন এখানে অতিথি পাখিরা এসে ভিড় করে।
আপনি শহীদ মিনার থেকে অথবা নতুন কলা ভবন থেকে ডান দিকে কিছুটা হেটে গেলেই অতিথি পাখিদের দেখা পাবেন।হাটতে হাটতে চোখে পরবে ছোট ছোট সাইন বোর্ড। আর এগুলোতে লিখা রয়েছেঃ “সামনে পাখির অভয়ারণ্য… পাখিদের বিরক্ত করবেন না… ঢিল ছুরবেন না। গাড়ীর হর্ন বাজাবেন না।”
এছাড়া আরও লিখা রয়েছেঃ পাখিদের প্রতি সদয় হোন… লেকের পাশে নীরবতা বজায় রাখুন… নিরাপদ দূরত্বে থেকে পাখি পর্যবেক্ষণ করুন… ছবি তোলার জন্য ঢিল ছুঁড়ে পাখিদের উড়াবেন না। লেক পরিষ্কার রাখুন; আবর্জনা, পানির বোতল, পলিথিন ফেলবেন না।
প্রজাপতির বাগান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে প্রজাপতির বাগান! এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে তা নয় সাথে রয়েছে জীববৈচিত্র্য।
এখানে আপনি প্রজাপতি বাগান দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন প্রজাপতিরা কিভাবে ইচ্ছেমত ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়িয়ে মধু খায়। এখানে কেউ তাদেরকে বিরক্ত করে না। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রজাপতিদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর আর প্রজননকেন্দ্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যা এর সুন্দর্য আর বাড়িয়ে দেয়।
শেষ কথা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আপনাকে জানতে হলে অবশ্যই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একবার হলেও ঘুরে আসতে হবে। যান্ত্রিক ঢাকা শহরের মাঝে একমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিবে। এই যান্ত্রিক শহরের বাইরে গিয়ে আলাদা এক জগত খুঁজে পাবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে প্রকৃতির কোলে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতে পারবেন অতিথি পাখি লেক খেলার মাঠ বিশ্ববিদ্যালয় পুরা ক্যাম্পাস জুড়ে রয়েছে অনাবিল সৌন্দর্য। মন চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন সাভারের অদূরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ধন্যবাদ।